December 28, 2024, 12:54 am

বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবির ঘটনায় নিহতদের পরিচয় মিলেছে

অনলাইন ডেস্ক
  • Update Time : Tuesday, June 30, 2020,
  • 138 Time View

বুড়িগঙ্গায় যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবির ঘটনায় মুন্সীগঞ্জে শোকের মাতম বইছে। এ ঘটনায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ডিসি এসপি শোক প্রকাশ করেছেন। সোমবার সকাল ৭টায় মিরকাদিম পৌরসভার (মুন্সীগঞ্জ) কাটপট্টি লঞ্চ ঘাট থেকে এক তলা বিশিষ্ট ছোট মর্নিং বার্ড লঞ্চটি শতাধিক অফিসগামী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার যাত্রী নিয়ে প্রতিদিনের মতো ঢাকা সদরঘাট লঞ্চ ঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, লঞ্চটি সদরঘাটের কাছাকাছি ফরাশগঞ্জ এলাকায় পৌঁছলে মর্নিং বার্ড লঞ্চটিকে চাঁদপুরগামী ৩য় তলা বিশিষ্ট বৃহৎ আকারের ময়ূর-২ লঞ্চটি পিছন দিক দিয়ে ধাক্কা দিলে মর্নিং বার্ড লঞ্চটি সাথে সাথে ডুবে যায়।

ওই লঞ্চের ছাদে থাকা কিছু যাত্রী সাঁতার কেটে জীবন বাঁচাতে পারলেও লঞ্চের ভেতরের অধিকাংশ যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই পর্যন্ত ৩২ যাত্রীর মৃতদেহ উদ্ধার করা গেলেও অনেকে নিখোঁজ আছেন।

সোমবার বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত নদীতে তল্লাশি চালিয়ে ৩১ জনের  মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল ও কোস্টগার্ড। উদ্ধার হওয়া ৩১ মরদেহের মধ্যে ১৯ জন পুরুষ, ৮ জন নারী এবং ৩ জন শিশু।

ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার রোজিনা আক্তার  বলেন, এখন পর্যন্ত ১৯ জন পুরুষ, ৮ নারী এবং ৩ টি শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

উদ্ধার হওয়া মরদেহগুলোর পরিচয় এখনও জানা যায়নি। দুর্ঘটনার কবলে পড়া লঞ্চটি মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিম লঞ্চঘাট থেকে ছেড়ে এসেছে এবং সে কারণে ধারণা করা হচ্ছে নিহত সকলের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে। লঞ্চ ডুবির ঘটনায় নিখোঁজদের উদ্ধারে এখনও অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

লঞ্চ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা জাহাঙ্গীর হোসেন ও নাসিমা আক্তার বলেন, কেরানীগঞ্জের একটি ডকইয়ার্ড থেকে মেরামত শেষে ময়ূর-২ নদীতে নামানোর সময় ওই দুর্ঘটনা ঘটে। ডুবে যাওয়া লঞ্চটি থেকে আমরাসহ কয়েকজন যাত্রী সাঁতরে পাড়ে উঠলেও এখনো অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন বলে তারা জানিয়েছেন।

কাটপট্টি থেকে ছেড়ে যাওয়া মর্নিং বার্ড লঞ্চ ডুবির ঘটনায় মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের এমপি অ্যাড. মৃণাল কান্তি দাস, মুন্সীগঞ্জ-২ আসানের এমপি অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমীন এমিলি, জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার, পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান, মিরকাদিম পৌর মেয়র মো. শহিদুল ইসলাম শাহীন শোক প্রকাশ করেছেন।

দুর্ঘটনাকবলিত মর্নিং বার্ড লঞ্চটির অধিকাংশ যাত্রী মিরকাদিম পৌর এলাকার চাকরিজীবী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাছাড়া আশে পাশের রামপাল, পঞ্চসার, আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নের যাত্রী থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

লঞ্চ ডুবির খবর পাওয়ার সাথে সাথে ঢাকাগামী মিরকাদিমের যাত্রীদের স্বজনদের মাঝে কান্নার রোল নেমে আসে, শোকের মাতম চলছে এলাকায়, অনেকে স্বজনদের খুঁজে লঞ্চ ডুবির স্থানে চলে যায় এবং কাটপট্টি লঞ্চঘাটে ভীড় করছেন।

মনিং বার্ড লঞ্চের বেঁচে যাওয়া যাত্রী ফল বিক্রেতা রিকাবী বাজারের পশ্চিম পাড়ার রহিম উদ্দিনের ছেলে মো. ওমর (৩৫) জানালেন, সকাল ৭টা ৫০ মিনিটের সময় তিনি মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে লঞ্চে ওঠে ঢাকায় যাচ্ছিলেন ফল কেনার জন্য।

তার সাথে অন্য তিনজন হকারও ছিল। শ্যামবাজারের কাছে গেলে ময়ূরী-২ লঞ্চের ধাক্কায় তাদের লঞ্চটি মুহূর্তেই ডুবে যায়।

এ সময় তিনি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আশপাশ থেকে নৌকা ও ট্রলার যাত্রীদের বাঁচাতে এগিয়ে আসে। আমাকে উদ্ধার করতে চাইলে আমি পাশের এক নারী ও একজন শিশুকে উদ্ধারের জন্য বলি।

পেছন দিকে তাকিয়ে দেখি পানির নিচ থেকে টপ টপ করে মানুষের মাথা বেড়িয়ে আসছে। কিভাবে কি হলো আমি নিজেই জানি না। আমাদের সাথে একজন হকারকেও খুঁজে পায়নি।

ঢাকার বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ ঢুবির ঘটনায় নিহতের অধিকাংশই মুন্সীগঞ্জের রিকাবী বাজারের পশ্চিম পাড়া, গোয়াল গুন্নি, রামপাল, কাঠপট্টি, বজ্রযোগিনী, রামশিং ও আব্দুল্লাপুর এলাকার। স্বজন হারানোর কান্নায় মুহূর্তেই ভারি হয়ে উঠেছে সেখানকার পরিবেশ। কেউ হারিয়েছেন স্বামী, কেউ স্ত্রী, কেউ ভাই, কেউ বোন আবার কেউবা মা-বাবা।

গতকাল সরজমিনে নিহতের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চলছে কান্নার রোল। স্বজন হারিয়ে কেই কাঁদছে হাউমাউ করে। আবার কেউ বোবা কান্না কাঁদছেন।

নির্বাক হয়ে অনেকে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। স্তব্ধ হয়ে গেছে পশ্চিম রিকাবী বাজার এলাকা। এখানে বাড়ি বাড়ি শোকের মাতম।

রিকাবী বাজার পশ্চিম পাড়ার মৃত আব্দুল রহিমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার ছেলে দিদার হোসেন (৪৫) ও মেয়ে রুমা বেগম (৪০) লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। এই দুই ভাইবোন তাদের অসুস্থ বড় বোনের জামাতাকে দেখতে ঢাকায় যাচ্ছিল।

কিন্তু শেষ আশা তাদের আর পূর্ণ হয়নি। বরং তার পূর্বে তাদের সলিল সমাধি হয়েছে। বাড়িটিতে চলছিল কান্নার রোল। এ খবর পেয়ে রুমার অসুস্থ দুলাভাই চলে এসেছে রিকাবী বাজারের বাড়িতে। এখানেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন।

পশ্চিম পাড়ার পরশ মিয়ার স্ত্রী সুফিয়া বেগম (৫৫) ও তার মেয়ে সুমা বেগম (২৫) যাচ্ছিলেন সদর ঘাটের সুমনা ক্লিনিকে ডাক্তার দেখাতে। স্ত্রী সুফিয়া বেগম মারা গেলেও প্রাণে বেঁচে গেছে মেয়ে সুমা বেগম।

তাদের বাড়িতে চলছে এখন শোকের মাতম। একই এলাকার শাহজাহান শরীফের পুত্র শিপলু শরীফ ঢাকায় যাচ্ছিলেন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য হার্ডওয়ারের মালামাল আনতে। কিন্তু লঞ্চ দুর্ঘটনায় তার বাড়িতে এখন শোকের মাতম।

এদিকে মীরকাদিমের মেয়র শহীদুল ইসলাম শাহীন এটাকে দুর্ঘটনা না বলে পরিকল্পিত হত্যা বলে দাবি করে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেছেন।

করোনা রোগে আক্রান্ত ঢাকা স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মিরকাদিম পৌরসভার মেয়র শহিদুল ইসলাম শাহীন লঞ্চ ডুবির খবর পেয়ে সাথে সাথে পৌরসভার কাউন্সিলারদের ক্ষতি গ্রস্তদের পাশে থাকার নির্দেশ দেন এবং মিরকাদিমের মানুষ মারা যাওয়ার খবরে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এটা পরিকল্পিতভাবে লঞ্চে আঘাত করে ডুবানো হয়েছে, তিনি নিহতদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করে দোষী লঞ্চের মালিক, স্টাফদের শাস্তি দাবি করেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।

নিহতদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করে দোষী লঞ্চের মালিক, স্টাফদের শাস্তি দাবি জানান মিরকাদিম পৌর নাগরিক কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন আহাম্মেদ, মিরকাদিম পৌর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মিলন।

এ বিষয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক মনিরুজ্জামান তালুকদার জানান, কতজন যাত্রী মারা গেছেন, কতজন জীবিত ফিরেছেন এমন সঠিক তথ্য এখনো পাননি।

তবে জেলার যারা মারা গেছেন তাদের পরিবারকে সরকারিভাবে যতটুকু সহযোগিতা করা যায় সেটা করা হবে। লঞ্চে ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী নেওয়া হলে এবং ফিটনেস ঠিক না থাকলে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দুর্ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের নাম পরিচয় হলো-

১ শাহাদত হোসেন (৪৮), পিতা আব্দুররহিম, গ্রাম গোয়ালঘুন্নি, মিরকাদিম মুন্সীগঞ্জ সদর।

২ আবু তাহের বেপারী (৫৮), পিতা আলীহোসেন, গ্রাম গোয়ালঘুন্নি, মিরকাদিম মুন্সীগঞ্জ সদর।

৩ স্মুন তালুকদার (৩৫), পিতা আবুলকালাম, গ্রাম গোয়ালঘুন্নি, মিরকাদিম মুন্সীগঞ্জ সদর।

৪ সরনা বেগম (৩৫), স্বামী মাসুদশেখ, টঙ্গিবাড়ি, মুন্সীগঞ্জ।

৫ মুক্তা আক্তার(১৩), পিতা মাসুদ শেখ, টঙ্গিবাড়ি, মুন্সীগঞ্জ।

৬ আফজাল শেখ (৪৮), পিতা ইব্রাহিম শেখ, বাঘিয়া, টঙ্গিবাড়ি, মুন্সীগঞ্জ।

৭ মো. মনিরুজ্জামান (৪২), পিতা আব্দুলহালিম, গ্রাম ছলিমাবাদ, আব্দুল্লাহপুর টঙ্গিবাড়ি, মুন্সীগঞ্জ।

৮ গোলাম হোসেন (৫০), পিতা আব্দুল হাকিম ভূঁইয়া, গ্রাম মশরীবাজার, রামপাল, মুন্সীগঞ্জ সদর।

৯  সুবর্ণা আক্তার (৩৫), স্বামী জাকির হোসেন, সুজানগর, রামপাল, মুন্সীগঞ্জ সদর।

১০ তামিম (১০), পিতা জাকির হোসেন, সুজানগর, রামপাল, মুন্সীগঞ্জ সদর।

১১ সাইদূর হোসেন (৩৯), পিতা মজিদ সারেং, মোল্লাকান্দি, মুন্সীগঞ্জ সদর।

১২ সুফিয়া বেগম (৫০), স্বামী পরশমিয়া, পশিমপাড়া, রিকাবীবাজার, মুন্সীগঞ্জ সদর।

১৩ মো. শহিদুল ইসলাম (৬৯), পিতা মৃত ইব্রাহিম শেখ, বাঘিয়া, যশলং টংগিবাড়ি।

১৪ মো. মিজানুর রহমান কনক (৩২)পিতা মো. দেলোয়ার হোসেন, ধলাগাও, রামপাল, মুন্সীগঞ্জ সদর।

১৫  সত্তরঞ্জন বনিক (৬৫), রামগোপালপুর, পিতা মৃত দেবেন্দ্র বনিক, মুন্সীগঞ্জ সদর।

১৬ মো. পাপ্পু (৩২)পিতা মো. সোহরাব, নহর দিঘিরপাড়, রিকাবীবাজার, মুন্সীগঞ্জ সদর।

১৭ বাসু দেবনাথ (৪৫), পিতা মৃত বাদল দেবনাথ, পাইকপাড়া, সিরাজদিখান।

১৮ আয়শা বেগম (৬৫), স্বামী পাচকরি বেপারী, কামারখাড়া, টঙ্গিবাড়ি।

১৯ মো. সাইফুর রহমান উজ্জ্বল (৪০), পিতা হাজী আব্দুররফ মাতবর, মালপারা, মুন্সীগঞ্জ সদর।

২০ বিউটি বেগম (৩৮), পিতা মৃত আলাউদ্দিন শেখ, ধলাগাও, রামপা, মুন্সীগঞ্জ সদর।

২১ ময়না বেগম (৩৫), পিতা আব্দুর রাজ্জাক, টঙ্গিবাড়ি।

২২ শামীম বেপারী (৪৭), পিতা মৃত আব্দুল জলিল, মিরেরপাড়া, মুন্সীগঞ্জ সদর।

২৩ মো. দিদার হোসেন (৪৫), পিতা আব্দুল মজিদ, নৈদিঘিরপাড়া, রিকাবীবাজার, মুন্সীগঞ্জ সদর।

২৪ মো. মিল্লাত (৩৫), পিতা আব্দুল সামাদ, পানহাটা, মুন্সীগঞ্জ সদর।

২৫ সিফাত (০৮), পিতা আব্দুর রহমান, আব্দুল্লাহপুর, টঙ্গিবাড়ি।

২৬ আলম বেপারী (৩৮), পিতা জয়নাল বেপারী, তারাহাটি, শ্রীনগর।

২৭ ইসলাম শরীফ (৩৫), পিতা জাহান শরীফ, রিকাবীবাজার, মুন্সীগঞ্জ সদর।

২৮ মো. সাইম (১৭), পিতা আফসারুদ্দিন, তিলারদি, মুন্সীগঞ্জ সদর।

২৯ হাফেজা খাতুন (৩৮), পিতা আব্দুল মজিদ, নৈদিঘিরপাড়, রিকাবিবাজার, মুন্সীগঞ্জ সদর।

৩০   তালহা (২), পিতা বেলায়েত হোসেন, আশরকাটি, টঙ্গিবাড়ি।

৩১ আমির হোসেন(৫৫), পিতা মৃত রুস্তম শরীফ, বানাঘাটা, দোহার, ঢাকা।

 

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: রায়তা-হোস্ট
tmnews71